৬. বাক্য
৬.১ বাক্যগঠনের শর্ত : আকাঙ্ক্ষা, আসত্তি ও যোগ্যতা
৬.২ খণ্ডবাক্য: স্বাধীন ও অধীন খণ্ডবাক্য
৬.৩ সরল, জটিল ও যৌগিক বাক্যের গঠন
৬.৪ কর্ম-অনুশীলন
এক বা একাধিক পদের দ্বারা যখন বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়, তখন তাকে বাক্য বলে। যেমন :
লেখ।
আমি খাই৷
কাজী সব্যসাচী বই পড়েন৷
বাক্যের পদগুলোর মধ্যে পারস্পরিক একটি সম্পর্ক বা অন্বয় থাকতে হয়, যার কারণে বক্তার মনোভাব বা বক্তব্য স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
লক্ষ কর :
গিয়ে পুকুরে বড় ধরেছি একটা মাছ।
খাঁ খাঁ অপু যাওয়ায় চলে করছে বাড়িটা।
বাক্য দুটোতে বক্তার মনোভাব পরিষ্কার নয়। কেননা, পদগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অন্বয় নেই। পদগুলো সুবিন্যস্ত নয়। তাই এগুলোকে বাক্য বলা যায় না। বাক্য হতে হলে পদগুলো সুবিন্যস্তভাবে সাজাতে হবে।
যেমন :
পুকুরে গিয়ে বড় একটা মাছ ধরেছি।
অপু চলে যাওয়ায় বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে।
সাধারণত কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়াপদ নিয়ে বাক্য গঠিত হয়। তবে একটি বাক্যকে সার্থক করে তুলতে আরও কতকগুলো গুণ বা শর্ত মানতে হয়।
একটি আদর্শ বা সার্থক বাক্য তখনই গঠিত হবে যখন বাক্যটির তিনটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকবে। এ গুণগুলো হচ্ছে:
১. আকাঙ্ক্ষা ২. আসত্তি ৩. যোগ্যতা
১. আকাঙ্ক্ষা : বাক্যের অর্থ পুরোপুরি বোঝার জন্য এক পদ শোনার পর অন্য পদ শোনার ইচ্ছা বা আগ্রহকে আকাঙ্ক্ষা বলে। যেমন :
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া ...
বললে বক্তার মনের ভাব সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। আরও কিছু বলার বাকি থাকে। আরো কিছু শোনার ইচ্ছা জাগে।
যদি বলা হয়—
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া করে। অথবা
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া করতো। অথবা
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া করবে।
তবে শোনার ইচ্ছাটি পূর্ণ হয়। আর এভাবে বাক্যও সম্পূর্ণ হয়।
২. আসত্তি : বাক্যের অর্থসংগতি রক্ষা করে পদগুলোকে যথাযথভাবে সাজিয়ে রাখার নাম আসত্তি। যেমন :
বাবা বাজার ইলিশ থেকে এনেছেন।
—এখানে বক্তা যা বলতে চেয়েছেন তার সব উপকরণ আছে। কিন্তু পদগুলো যথাযথভাবে সাজানো হয় নি। ফলে সুস্পষ্ট কোনো অর্থও প্রকাশ পায় নি। কিন্তু—
বাবা বাজার থেকে ইলিশ এনেছেন৷
এভাবে লেখা হলে বক্তব্যটির অর্থ পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে একটি সুগঠিত বাক্য হতো। তাই সার্থক বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলোর যথাযথ অবস্থানে থাকা আবশ্যক।
৩. যোগ্যতা : বাক্যের অন্তর্গত পদগুলোর মধ্যে অর্থের সংগতি ও ভাবের মিলবন্ধনকে যোগ্যতা বলে। যেমন : আমরা বড়শি দিয়ে মাছ ধরি।
আমরা বড়শি দিয়ে মাছ ধরি।
এটি একটি সার্থক বাক্য। কেননা এখানে পদগুলোর অর্থগত ও ভাবগত মিল রক্ষিত হয়ে তা বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু-
আমরা বড়শি দিয়ে নারকেল পাড়ি।
বললে বক্তব্যটিতে অর্থ ও ভাবের অসংগতি প্রকাশ পায়। তা বিশ্বাসযোগ্যও হয় না। কারণ বড়শি দিয়ে কেউ নারকেল পাড়ে না। সুতরাং বাক্যে পদগুলোর মধ্যে অর্থের সংগতি ও ভাবের মিল রক্ষা করা আবশ্যক। নয়তো যোগ্যতার অভাবে তা বাক্য হবে না।
প্রতিটি বাক্যের দুটি অংশ থাকে :
১. উদ্দেশ্য : বাক্যে যার সম্পর্কে কিছু বলা হয়, তাকে উদ্দেশ্য বলে। যেমন :
শিমুল মাঠে খেলতে গেল৷
২. বিধেয় : বাক্যে উদ্দেশ্য সম্পর্কে যা বলা হয়, তাকে বিধেয় বলে। যেমন :
শিমুল মাঠে খেলতে গেল।
একটি উদ্দেশ্য ও একটি বিধেয় ক্রিয়ার (সমাপিকা) সমষ্টি যদি নিজে একটি স্বাধীন বাক্য হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে অন্য কোনো বৃহত্তর বাক্যের অংশরূপে ব্যবহৃত হয়, তাকে খণ্ডবাক্য বলে। যেমন :
যারা ভালো ছেলে, তারা শিক্ষকের আদেশ পালন করে।
–এ বাক্যে দুটি খণ্ডবাক্য আছে :
১. যারা ভালো ছেলে
২. তারা শিক্ষকের আদেশ পালন করে।
দুটি বাক্যই যেহেতু একটি বড় বাক্যের অংশ, সেহেতু বাক্যাংশ দুটি বড় বাক্যের খণ্ডবাক্য। খণ্ডবাক্যে একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া থাকে এবং তা অন্য একটি বাক্যের অংশরূপে ব্যবহৃত হয়।
খণ্ডবাক্য দু রকমের হয়। যথা : ১. স্বাধীন খণ্ডবাক্য ২. অধীন খণ্ডবাক্য
১. স্বাধীন খণ্ডবাক্য : একটি বড় বাক্যের অন্তর্গত যে খণ্ডবাক্য তার নিজের অর্থ প্রকাশের জন্য অন্য কোনো খণ্ডবাক্যের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাকে স্বাধীন বা প্রধান খণ্ডবাক্য বলে। যেমন :
যারা ভালো ছেলে, তারা শিক্ষকের আদেশ পালন করে।
এ বাক্যের ‘তারা শিক্ষকের আদেশ পালন করে'— এ খণ্ডবাক্যটিকে আলাদা বাক্য হিসেবেও লেখা যেতে পারে । স্বাধীন খণ্ডবাক্যকে সম্পূর্ণ বাক্য থেকে তুলে নিয়ে আলাদাভাবে লিখলেও তার পূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায়।
২. অধীন খণ্ডবাক্য : একটি বড় বাক্যের অন্তর্গত যে খণ্ডবাক্যটি তার অর্থ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার জন্য স্বাধীন খণ্ডবাক্যের ওপর নির্ভরশীল, তাকে অধীন খণ্ডবাক্য বা আশ্রিত বা অপ্রধান খণ্ডবাক্য বলে। অধীন খণ্ডবাক্যকে সম্পূর্ণ বাক্য থেকে তুলে নিয়ে আলাদাভাবে লিখলে তার পরিপূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায় না, আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়। যেমন :
যারা ভালো ছেলে, তারা শিক্ষকের আদেশ পালন করে।
এ বাক্যের ‘যারা ভালো ছেলে' খণ্ডবাক্যকে আলাদা করে লিখলে ‘আকাঙ্ক্ষা' গুণের বিঘ্ন ঘটে।
অধীন খণ্ডবাক্য তিন রকমের :
ক. বিশেষ্যস্থানীয় অধীন খণ্ডবাক্য : যে অধীন খণ্ডবাক্য স্বাধীন খণ্ডবাক্যের যেকোনো পদের অধীন থেকে বিশেষ্যের কাজ করে, তাকে বিশেষ্যস্থানীয় অধীন খণ্ডবাক্য বলে। যেমন :
আমি বাড়ি গিয়ে দেখলাম, সবার খাওয়া হয়ে গেছে।
খ. বিশেষণস্থানীয় অধীন খণ্ডবাক্য : যে অধীন খণ্ডবাক্য স্বাধীন খণ্ডবাক্যের অন্তর্গত কোনো বিশেষ্য বা সর্বনামের দোষ, গুণ, অবস্থা প্রকাশ করে, তাকে বিশেষণস্থানীয় অধীন খণ্ডবাক্য বলে। যেমন :
যে পরিশ্রম করে, সে-ই সুখ লাভ করে। (অধীন খণ্ডবাক্যটি ‘সে-ই' সর্বনামের অবস্থা প্রকাশ করছে)
গ. ক্রিয়া-বিশেষণস্থানীয় অধীন খণ্ডবাক্য : যে অধীন খণ্ডবাক্য ক্রিয়াপদের স্থান, কাল ও কারণ নির্দেশক অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাকে ক্রিয়া-বিশেষণস্থানীয় অধীন খণ্ডবাক্য বলে। যেমন :
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে। ’
গঠন অনুসারে বাক্য তিন প্রকার। যথা :
১. সরল বাক্য
২. জটিল বাক্য
৩. যৌগিক বাক্য
১. সরল বাক্য : যে বাক্যে একটি কর্তা বা উদ্দেশ্য ও একটিই সমাপিকা ক্রিয়া বা বিধেয় থাকে, তাকে সরল বাক্য বলে। যেমন :
খোকন বই পড়ছে।
আমি বহু কষ্টে সাঁতার শিখেছি।
জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই।
২. জটিল বাক্য : যে বাক্যে একটি স্বাধীন বাক্য এবং এক বা একাধিক অধীন বাক্য পরস্পর সাপেক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়, তাকে জটিল বাক্য বা মিশ্র বাক্য বলে। যেমন :
যিনি পরের উপকার করেন, তাঁকে সবাই শ্রদ্ধা করে।
কোথাও পথ না পেয়ে তোমার কাছে এসেছি।
তুমি আসবে বলে আমি অপেক্ষা করে আছি।
৩. যৌগিক বাক্য : দুই বা তার অধিক সরল বা জটিল বাক্য মিলিত হয়ে যদি একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করে, তবে তাকে যৌগিক বাক্য বলে। যেমন :
ছেলেটি গরিব কিন্তু মেধাবী।
দুঃখ এবং বিপদ এক সাথে আসে।
এতক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু গাড়ি পেলাম না।
জটিল ও যৌগিক বাক্য একাধিক বাক্যাংশ বা বাক্য দিয়ে গঠিত।
জটিল বাক্যের অন্তর্গত বাক্যাংশগুলো পরস্পর সাপেক্ষ, একটি অপরটির ওপর নির্ভরশীল।
যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত বাক্যগুলো প্রায় স্বতন্ত্র। ও, এবং, আর, অথচ, কিংবা, বরং ইত্যাদি অব্যয়যোগে যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত খণ্ডবাক্যগুলো যুক্ত হয় । যেমন :
জটিল যদিও লোকটি ধনী, তবুও সে কৃপণ।
যৌগিক : লোকটি ধনী কিন্তু কৃপণ।
জটিল : যদিও তাঁর টাকা আছে, তবু তিনি দান করেন না।
যৌগিক : তাঁর টাকা আছে কিন্তু তিনি দান করেন না।
জটিল : যখন বিপদ আসে, তখন দুঃখও আসে।
যৌগিক : বিপদ এবং দুঃখ একই সাথে আসে।
১. তোমার বাড়িতে ৩/৪ বছর বয়সের কোনো শিশু আছে? থাকলে (না থাকলে অন্য বাড়ির) তার আধো-আধো কথাগুলো মন দিয়ে শোনার ও বোঝার চেষ্টা কর। দেখবে সে অল্প কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করে তার মনের সকল ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করছে। সেগুলো তোমার কাছে অসংলগ্ন বা এলোমেলো ও হাস্যকর মনে হবে। তার এই এলোমেলো কথাগুলো তোমার বিবেচনায় বাক্যের কোনো গুণ বা লক্ষণ ব্যাহত করেছে? আধো-আধো কথা বলা কোনো শিশুর কিছু অসংলগ্ন হাস্যকর কথার উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত কর। (এটি একটি দলবদ্ধ কাজও হতে পারে।)
২. নিচের বাক্যগুলোতে গঠনগত দিক থেকে কোন কোন গুণের অভাব ঘটেছে খাতায় লেখ :
ক. কাল আমি যাব ট্রেনে বাড়ি করে।
খ. সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হয়।
গ. মন দিয়ে কর সবে …..।
৩. একটি কর্তা ও একটি সমাপিকা ক্রিয়া আছে এমন দশটি বাক্য লেখ। এরপর সমাপিকা ক্রিয়াকে অপরিবর্তিত রেখে বাক্যটির কোনো অংশকে জটিল বাক্যে রূপান্তর কর। তারপর যথাসম্ভব সংযোজক বা বিয়োজক অব্যয়ের প্রয়োগে বাক্যটিকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তর কর। যেমন :
তার বয়স হলেও বুদ্ধি হয় নি।
জটিল বাক্য : তার বয়স হয়েছে, বুদ্ধি হয় নি।
যৌগিক বাক্য : তার বয়স হয়েছে কিন্তু বুদ্ধি হয় নি।